অনলাইন ডেস্কঃ ভারতের অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, ভারত মহাসাগরে চীন তাদের দেশের জন্য হুমকি হতে পারে না। যদিও আমি মনে করি, এমন ঘটতে পারে। তবে এজন্য কিছুটা হলেও প্রণোদনামূলক কাজ প্রয়োজন। তবে এই প্রণোদনাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতিও রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে ভারত ক্ষতির দিকে ঝুঁকবে।
আমি যখন ভারতের রাজস্থান সফরে যাই তখন তিন দিনব্যাপী ‘কোয়াড-প্লাস ডায়ালগ’ চলছিল। সেখানে ভারত মহাসাগরের শক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ‘কোয়াড’; ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক জোট।
আমার প্যানেলের বিষয় ছিল প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর শাসন। বৈঠকে চীনের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে যা কাউকে অবাক করেনি। সর্বোপরি পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্রের স্বাধীনতার জন্য চীন একটি বড় শক্তি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং সাধারণ নাগরিকরাও মনে করে, পানি ও আকাশ তাদের অঞ্চলের মতো করেই দখল, নিয়ন্ত্রণ এবং গণতান্ত্রিক আইনের মাধ্যমে শাসন করা যাবে। শীর্ষ নেতাদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) পূর্বাভাস অনুযায়ী দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থান করছে।
ভারত মহাসাগরে কীভাবে পাহারা দেওয়া যায়, তার চেয়েও সমুদ্রের স্বাধীনতার জন্য পরাশক্তির দেওয়া চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে তা নিয়েই বেশি চিন্তা করা হচ্ছে। আমিও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। এছাড়াও জলদস্যু, অস্ত্র পাচারকারী এবং সমুদ্র সন্ত্রাসীরা দক্ষিণ এশিয়ায় সমুদ্র স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রধান হুমকি। বেইজিংসহ সবাই এডেন উপসাগর অথবা বঙ্গোপসাগরে সংঘর্ষ প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। মালাক্কার পশ্চিমে অন্যান্যদের সঙ্গে চীন যৌক্তিকভাবেই ভালো ভূমিকা রেখেছে।
যাই হোক, আমাদের প্যানেলকে অনুসরণ করে প্রশ্নোত্তর পর্বে আমি ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল এবং জেনারেলের কাছে জানতে চাই, কতদিন ধরে এই বর্তমান সময়ের ভালো অনুভূতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। সর্বোপরি এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীকে পরাজিত করার জন্য পিএলএ নৌবাহিনী কবে নাগাদ শক্তিশালী হবে?
সুসংবাদ হচ্ছে- আমরা সবাই সম্মত হয়েছি অশান্তি খুব নিকটবর্তী নয়। মাঝেমাঝে বিরক্তিকর মনে হলেও আঞ্চলিক জলসীমায় পিএলএর উপস্থিতি এখন পর্যন্ত খুব বেশি হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। ভিন্ন ভিন্ন পথে হলেও আমরা একটি ভালো উপসংহারে পৌঁছাতে পেরেছি। ভারতীয় প্রতিনিধিরা চীনের ‘সক্ষমতার’ সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে মতামত দিয়েছিল যে ভারত মহাসাগরে যুদ্ধ সক্ষম নৌ স্কোয়াড্রন স্থাপন করতে পিএলএকে ‘কমপক্ষে ১৫ বছর’ অপেক্ষা করতে হবে। এ ধরনের একটি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী চীনা হুমকিকে অনেকটাই নিস্তেজ করে দেয়। অবশ্য বিগত কয়েক দশক ধরে চীনের সামরিক বাহিনী যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে করে সর্বোপরি বিষয়টি এতোটা ইতিবাচক নাও হতে পারে। তবুও আসুন আশাবাদীদের দৃষ্টি অনুসরণ করি।
পিএলএ নেভির ‘সক্ষমতা’ কী? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের অবশ্যই কিছু প্রযুক্তিগত সংবেদনশীল হার্ডওয়্যারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে- জাহাজ, উড়োজাহাজ, প্রতিরক্ষা অস্ত্র উৎপাদন অথবা বিদেশ থেকে কেনা অস্ত্র। ‘সক্ষমতার’ বিষয়টি লজিস্টিকসকেও অনুসরণ করে, বিশেষ করে যখন একটি নৌবাহিনী দূরবর্তী সমুদ্রে স্থায়ী উপস্থিতি স্থাপনের কথা চিন্তা করে। আধুনিক নৌবাহিনী স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না, এমনকি পারমাণবিক শক্তিধর যুদ্ধজাহাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণ এসব যুদ্ধজাহাজ বুলেট, বিন ও ব্ল্যাকঅয়েলের শক্তি সরবরাহ ছাড়া দীর্ঘ সময় চলতে পারে।
দূরবর্তী জলসীমায় স্থায়ীবহর স্থাপনের জন্য সংক্ষেপে হলেও নৌবাহিনীর প্রয়োজন ঘাঁটি। যার সঙ্গে থাকবে গোলাবারুদের ডিপো, শুকনো ডক, সব ধরনের ওয়ার্কশপ এবং অন্যান্য আরও কিছু। এক বা একাধিক নৌ স্টেশন ছাড়া ভারতীয় উপসাগরে অবস্থান নেওয়া বেইজিংয়ের জন্য কঠিন হবে। এক্ষেত্রে লজিস্টিকের ঘাটতি পূরণে চীনকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গত মাসে সাংবাদিকদের জানানো হয়, পূর্ব আফ্রিকার জিবুতিতে চীন তাদের প্রথম নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে।
তবে যাই হোক না কেন, ভারতীয় মহাসাগরে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে তুলে ধরতে বেইজিং যে কিছু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই অঞ্চলে যদি স্থায়ী উপস্থিতির প্রয়োজন হয় সে জন্য নিজের জন্য বিকল্প খুঁজছে। পাকিস্তানের গোয়াদার অথবা শ্রীলংকার কলম্বোর মতো কৌশলগত অবস্থানে থাকা সমুদ্রবন্দরে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে উন্নয়ন যেমন সম্ভাব্য আয়োজক দেশগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখে তেমনি ঋণের ফাঁদে ফেলার একটি সম্ভাবনাও তৈরি করে। ভবিষ্যতে নৌ প্রবেশাধিকার নিয়ে আলোচনার সময় চীন এ ধরনের সুবিধা চাইতে পারে।
এই প্রক্রিয়াতেই ভারতীয় মহাসাগরে চীন তার কৌশলগত অবস্থান সমুন্নত করবে। কোয়াডের আলোচনায় অংশ নেওয়া এক-চতুর্থাংশ প্রতিনিধিই ভারতের অংশে চীনের অনুপ্রবেশ নিয়ে আপত্তি জানায়। তারা আশা প্রকাশ করে, নয়াদিল্লি ও বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো বেইজিংকে এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায়তা করার মতো সংক্ষেপ, ধারাবাহিক ও নির্দিষ্ট অভিযানের বিষয়ে উৎসাহ দেবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে ভারতীয়রা চায়, চীন সমুদ্রশক্তির স্থায়ী ঘাঁটি লজিস্টিক পিলার এড়িয়ে চলুক।
ভারতীয়রা চীনের সাবমেরিন নিয়ে বিশেষ উদ্বেগে থাকে। জয়পুরে উপস্থিত ভারতীয় প্রতিনিধিরা আঞ্চলিক জলসীমায় পিএলএ নেভির সাবমেরিনের উপস্থিতি নিয়ে বারবার বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে চীনের পক্ষ থেকে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, চীনা সাবমেরিনগুলো ভারত মহাসাগরে জলদস্যুতা ঠেকায়। এছাড়া এডেন উপসাগরের আশেপাশে স্পিডবোটগুলো তাড়া করার জন্যও এসব সাবমেরিন নিযুক্ত থাকে। সংশয়বাদী ভারতীয়রা বেইজিংয়ের অভিযানগুলো নিয়ে এসব গল্পে বিশ্বাস করে না।
এ অবস্থায় ভারতীয় মহাসাগরে আধিপত্য দখল করতে পিএলএর ১৫ বছর লাগবে কি না ,তা এখন সবার প্রশ্ন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেশগুলোর আঞ্চলিক নৌবাহিনী তৈরি করতে প্রায় ১৫ বছর লেগেছে এবং বৈশ্বিক নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ বছর। আর চীন মাত্র দুই দশক ধরে তাদের শক্তি গঠন করছে। এক্ষেত্রে চীনের সামুদ্রিক সম্ভাবনা ভারতের কাছে অযৌক্তিক বলেই মনে হয়।
আমার কাছে মনে হয় ভারত মহাসাগরে চীন রাতারাতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে যদি তারা পিএলএ নৌবাহিনীকে বিশেষভাবে তৈরি করে নেয়। শুধু তা-ই নয়, চীন সাগরগুলোয় তাদের স্বার্থ ও আগ্রহের বিষয়াদি নিয়ে তারা বড়ধরনের ঝুঁকি নিতে পারে। সূত্রঃ সময় নিউজ